অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, বুধবার, ১৪ই মে ২০২৫ | ৩১শে বৈশাখ ১৪৩২


স্টেশনমাস্টার পদের উন্নয়ন ব্যতীত রেলের কাঙ্খিত উন্নয়ন অসম্ভব


বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাত ১১:২৬

remove_red_eye

৩৮৩৬

এম শরীফ আহমেদ।। "স্টেশনমাস্টার" বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ। বিভিন্ন ব্যক্তিগন এই পদটিকে বিভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কেউ এই পদটিকে বলেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের "চোখ" তো কেউ বলেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের "আয়না" আবার কেউ বলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের "প্রাণ "। বাংলাদেশ সহ বহিঃবিশ্ব থেকে আগত সকল নাগরিক'ই ট্রেন ভ্রমনের জন্য এই স্টেশনমাস্টারের নিকট সেবা ও সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
 
ট্রেন পরিচালনার পাশাপাশি বাংলাদেশ রেলওয়ের বাকি সকল বিভাগের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করা ও যাত্রী সেবা দেওয়া এই স্টেশনমাস্টার পদের মূল কাজ।
 
অর্থাৎ বাংলাদেশ রেলওয়ের অভ্যন্তরীন ও বাহ্যিক উভয় কাজেই করতে হয় এই পদে কর্মরতদের। বিশেষ করে ট্রেন পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে সম্পাদন করা একটি মানসিক চাপের কাজ। কারণ, স্টেশনমাস্টারের সামান্য ভুলেই ঘটে যেতে পারে বিশাল ট্রেন দূর্ঘটনা। হতাহত হতে পারে অসংখ্য যাত্রী। ক্ষতি হতে পারে কোটি কোটি টাকার রেলওয়ের সম্পদ। 
 
কিন্তু লোকবলের সংকটে বিনা বিশ্রামে এতো মানসিক চাপ নিয়েই স্টেশনমাস্টার'দের দায়িত্ব পালন করে যেতে হয় মাসের ৩০ দিনই! 
নেই কোন সরকারী ছুটি, ঈদ,পূজা,ঝড়,বৃষ্টিতেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিরাপদে  ট্রেন পরিচালনা করে যাচ্ছে স্টেশনমাস্টারগন।। 
 
বিশেষ করে পর্যাপ্ত রেষ্ট না পাওয়া সত্ত্বেও রাত্রিবেলায় ট্রেন পরিচালনা করতে ব্যাপক কষ্ট করতে হয় এই স্টেশনমাস্টারদের। 
কোনো ধরনের সরকারী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না এই পদে কর্মরতদের। সরকারী চাকুরীতে মাসের ৩০ দিনই ডিউটি ও "নাইট ডিউটি" বিনা ভাতা'তে কেবলমাত্র স্টেশনে কর্মরত কর্মচারীগনই কেবল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন বলে জানান স্টেশনমাস্টার' ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ।
 
সরকারী সুযোগ-সুবিধা প্রদানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা না মানায়, রেল প্রশাসন সরকারী নিয়ম বর্হিভূত কাজ করাচ্ছে বলে জানায় স্টেশনমাস্টার' ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ'গন।বাংলাদেশ রেলওয়েতে শ্রম আইনের কোনো ব্যবহার নেই বলে ক্ষুব্ধ স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ।
 
নাম না প্রকাশে একজন স্টেশনমাস্টারের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, স্টেশনে বিভিন্ন পেশাজীবির কর্মকর্তাগন সেবার জন্য আসেন। কিন্তু একজন ১৫ তম গ্রেডের কর্মচারী হিসেবে আমরা ৯ম বা ৩/৪ গ্রেডের কর্মকর্তাদের সঠিক সেবা দিতে পারি না বিধায় তারা অনেক সময় মনোক্ষুণ্ণ হোন। কারণ তারা তাদের অবস্থান থেকে যে সেবা কাম্য করে সেই অবস্থানে তো স্টেশনমাস্টারগন নেই। এমনকি স্টেশনের বাথরুমে ব্যবহারের জন্য একটি ৫টাকা মূল্যের সাবান কেনারও সার্মথ্য নেই একজন স্টেশনমাস্টারের।তার জন্য বিভাগীয় ষ্টোর অফিস হতে চাহিদাপত্রের মাধ্যমে স্টেশনে "যাত্রীদের জন্য" ব্যবহার সামগ্রী চেয়ে আনতে হয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা তাৎক্ষণিক দেওয়া সময় সম্ভব হয় না বলে মনে করেন স্টেশনমাস্টারগন। 
 
এছাড়াও, স্টেশনমাস্টার'দের বেতন স্কেল স্টেশনে কর্মরত অন্যান্য কর্মচারীদের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় স্টেশনে কর্মরত অন্যান্য কর্মচারী'গন স্টেশনমাস্টার'দের ঠিকমতো সহযোগিতা করে থাকেন না।
যেমন একজন স্টেশনমাস্টার স্নাতক পাশ ও বেতন স্কেল ১৫ তম গ্রেডের। অপর পক্ষে একই স্টেশনে কর্মরত টিএক্সআর এইচএসসি পাশ যার স্কেল ১২ তম গ্রেডের!!আবার গার্ডদের বেতন স্কেল ১৪ তম গ্রেড ও এইচএসসি পাশ। অথচ এই গার্ডদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন স্টেশনমাস্টার। 
 
এই বিষয়ে  বাংলাদেশ রেলওয়ের আনুষঙ্গিক নিয়মাবলী থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম তুলে ধরেন স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়েনের নেতৃবৃন্দ। যা নিম্নরুপঃ- 
 
জিএস -৪০ঃ- "স্টেশন" বলিতে কোন রেলওয়ের উপর অবস্থিত যে স্থানে ট্রাফিকের ( যাত্রী, মালামাল, ও জীবজন্তু যাতায়াত)  লেনদেন হইয়া থাকে তাহাকে বুঝায়।।
 
জিএস- ৪২ঃ-"ষ্টেশন মাস্টার" বলিতে এমন কর্তব্যরত রেল কর্মচারীকে বুঝায় যিনি "ষ্টেশন সীমা"র মধ্যে ট্রাফিক সংক্রান্ত সাধারণ কার্যাবলী পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। 
 
জিএস-৪১ঃ- ষ্টেশন সীমা বলতে বুঝায় যাহা একজন ষ্টেশন মাষ্টার নিয়ন্ত্রণ করিয়া থাকেন এবং উহা ষ্টেশনের সবচাইতে দূরবর্তী সিগনালদ্বয়ের মধ্যে অবস্থিত। 
 
জিএস-৩৯ঃ- সিগনাল, পয়েন্ট প্রভৃতির পরীক্ষা নিরীক্ষা।-(অ)  সকল পয়েন্ট, সিগনাল, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদি এবং অন্যান্য সরঞ্জামসমূহকে সর্বদা সঠিকভাবে চালু অবস্থায় রাখা হইবে এবং ইহাদের মধ্যে কোনরুপ ত্রুটি ধরা পড়িলে কিংবা ইহাদের কোনরুপ ত্রুটি সরানো হইলে, সংশ্লিষ্ট ষ্টেশন মাষ্টার তাহা সাথে সাথেই তাহা সঠিক কতৃপক্ষ এবং রক্ষনাবেক্ষনের জন্য দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে জানাইবেন।
 
জিএস -৯৬ঃ- স্টেশন সীমায় গার্ডের উপর কর্তব্য।যখন কোন ট্রেন স্টেশন সীমার মধ্যে অবস্থান করে তখন ট্রেনটির গার্ড উক্ত স্টেশনের স্টেশনমাস্টারের কতৃত্বাধীন থাকিবেন।
 
জিএস -১০৫ঃ-ট্রেন ছাড়িবার পূর্বে ট্রেন সমূহের পরীক্ষা।যখন কোন স্টেশনে ট্রেন, ট্রেন পরীক্ষক(টিএক্সআর) দ্বারা পরীক্ষিত হয়,তখন স্টেশনমাস্টার যে পর্যন্ত না ট্রেন পরীক্ষকের নিকট হইতে এই মর্মে সংবাদ পান যে ট্রেনটি যাইবার উপযুক্ত সে পর্যন্ত ট্রেনটিকে ছাড়িয়া যাইবার অনুমতি দিবেন না।
 
আঃ নিঃ ১০৫ঃ-ক - ট্রেন পরীক্ষক তাহার প্রতিবেদনটি ট্রেনের গার্ডের কাছে হস্তান্তর করিবার পূর্বে অবশ্যই তাহাতে কর্তব্যরত স্টেশনমাস্টারের প্রতিস্বাক্ষর লইয়া লইবেন।
 
জিএস ১৮৫ঃ-কার্য পরিচালন বিষয়ে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্ব। -(ক) স্টেশনে অথবা স্টেশন সীমার মধ্যে তাহার আজ্ঞাধীন স্থায়ী অথবা অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত বিভিন্ন কর্মচারীর উপরে ন্যস্ত কর্তব্যকর্মের সম্পাদনের জন্য স্টেশনমাস্টার দায়ী থাকিবেন; এবং এইরুপ কর্মচারীবৃন্দ স্টেশন কার্য পরিচালন বিষয়ে তাহার ক্ষমতাধীন ও নির্দেশাধীন থাকিবেন।
 
জিএস ১৮৯ঃ-রেলওয়ে সম্পদের বিষয়ে স্টেশনমাস্টারের দায়িত্বঃ- স্টেশন মাস্টার তাহার স্টেশনস্থিত রেলওয়ে প্রশাসনের সম্পদের নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের জন্য দায়ী হইবেন।
 
এককথায় ট্রেন পরিচালনার সাথে জড়িত সকল কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত স্টেশনমাস্টার পদটি।অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি দীর্ঘদিন যাবৎ  বেতন বৈষম্যের স্বীকার। নিরাপদে ট্রেন পরিচালনা'সহ কাঙ্খিত যাত্রী সেবা নিশ্চিত করতে স্টেশনমাস্টার পদটির উন্নয়নের বিকল্প নেই।
 
তাই স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা দাবী করেন যে, সরকার যেমন সেবার সাথে  জড়িত অন্যান্য পদগুলোকে ১০ম গ্রেডে উন্নীত করেছেন (যেমন পুলিশের এসএই, সার্জেন্ট, নার্স, প্রধান শিক্ষক, ব্যাংকের কর্মচারীদের সহ অনেক পদকে) ঠিক তেমনি বাংলাদেশ রেলওয়েতে স্টেশনমাস্টার পদটিতে মেধাবী শিক্ষিত তরুনদের আকৃষ্ট করতে এই পদটিকেও ১০ম গ্রেডে উন্নীত করে নিরাপদে ট্রেন পরিচালনাসহ কাঙ্খিত যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধিতে রেলওয়ে সম্প্রতি যে নিয়োগবিধি ২০২০ সংশোধনী করছে, তাতে স্টেশনমাস্টার'দের ০৬ টি পদকে ভেঙে ০২ টি পদে উন্নীত করলে অর্থাৎ ১০ম ও ৯ম গ্রেডে উন্নীত করতে পারলে নিরাপদে ট্রেন পরিচালনা ও সেবার মান বহুগুনে বৃদ্ধি পাবে বলে স্টেশনমাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ আশাবাদী।
 
 
লেখকঃএম শরীফ আহমেদ 
(তরুণ উদ্যোক্তা,স্বেচ্ছাসেবী ও সাংবাদিক)