অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, বুধবার, ১৪ই মে ২০২৫ | ৩১শে বৈশাখ ১৪৩২


মনপুরায় কৃষকের ডাব ৫০ টাকা থেকে হাত বদলে ২০০ টাকা


মনপুরা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৩ই মে ২০২৫ সন্ধ্যা ০৬:৩৬

remove_red_eye

২৮

ন্যার্য দাম থেকে কৃষকরা বঞ্চিত কৃষক, লাভবান বিক্রেতারা

সোহাগ মাহামুদ সৈকত, মনপুরা : চলমান গড়মের মধ্যে ডাবের চাহিদা বেড়েছে সারাদেশে। তবে অন্যান্য জেলার চেয়ে ভোলার মনপুরা ডাবের চাহিদা বেশি সারাদেশে রয়েছে। তাই ভোলার মনপুরা কৃষকদের ডাব বিভিন্ন হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। এরমধ্যে সব চেয়ে বেশি পরিমাণ ডাবই চলে যায় ঢাকার বিভিন্ন পাইকারী আড়তে। কৃষকদের অভিযোগ তাদের থেকে পাইকাররা কম দামে ডাব ক্রয় করলেও ঢাকার বাজারে বিক্রি করেন উচ্চ মূল্যে। তাই বাজারে ডাবের দাম বেশি হলেও  কৃষকরা বঞ্চিত ন্যার্য মূল্য থেকে।
ভোলার বিচ্ছিন্ন উপজেলার মনপুরায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মনপুরার স্থানীয় ৬০-৭০ জন পাইকার রয়েছে গ্রামের বাড়ি বাড়িতে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে ডাব ক্রয় করেন। তারা প্রতিদিন সকাল ৬ টাকা থেকে বিকেল পর্যন্ত মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট, মনপুরা, দক্ষিণ সাচুচিয়া, উত্তর সাকুচিয়া ও কলাতলির চরে ঘুরে বেড়ান। আর কৃষকদের ডাব পছন্দ হলেই দর-দাম করেই কিছু টাকা বায়না করেন যান তারা। পরের দিন সকাল ৬ টায় থেকেই ওই ডাব গাছ থেকে কেটতে থাকনে। দুপুর ১২ টা পর্যন্ত কাটেন ওই ডাব। পরে অটোরিক্সা ও ভ্যানে করে নিয়ে যান যার যার গোডাউনে গোডাউনে। সেখান থেকেই ওই দিনই স্টিমার ও ঢাকার লঞ্চে করে পাঠিয়ে দেন ঢাকার পাইকারী আড়তে।
হাজিরহাট  ইউনিয়নের চর ফৈজুদ্দিন গ্রামের কৃষক মো: আব্বাস উদ্দিন জানান, তার আগে ২ থেকে ৩ শ' নারিকেল গাছ ছিলো। কিন্তু নদী ভাঙনের কারণে অনেক গাছ বিলিন হয়ে গেছে। বর্তমানে তার প্রায় শতাধিক গাছ রয়েছে। ওই গাছ  থেকে প্রতি বছরই তিনি ডাব বিক্রি করে থাকেন। এবছরও তিনি মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত ২ হাজার পিস ডাব বিক্রি করেছেন। ৫০ থেকে ৬০  টাকা করে তাকে পাইকাররা দিয়েছে। তাকে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার মত পেয়েছেন।
দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের  কৃষক মো: ইসমাইন হোসেন জানান, প্রতি বছরই তিনি গাছের ডাব বিক্রি ভালো টাকা আয় করেন থাকেন। ডাব বিক্রি টাকা দিয়ে তিনি আরো কিছু নারিকেল গাছের চারা লাগিয়েছেন। কিছু টাকা দিয়ে সংসার পরিচালনা করেন আর কিছু টাকা দিয়ে তিনি গরু কিনেছেন।
তিনি আরো জানান, ডাবের ব্যাপারীরা আমাদের কাছে এসে প্রথমে ৩০ টাকা থেকে দাম বলতে থাকে। পরে বাড়তে বাড়তে সর্ব্বোচ ৫৫ টাকা বেশি পাই না। তাকে দিয়ে দেই কারণ গাছ থেখে ডাব কাটার কোন টেনশন নেই। ওরাই লোকজন নিয়ে এসে ডাব পেরে নেন। বাজারের তুলনায় কম টাকা পেলেও কিছু করার নেই।
একই ইউনিয়নের বাংলাবাজার গ্রামের কৃষকরা মো: জামাল হোসেন জানান, আমাদের থেকে সর্ব্বোচ ৬০ টাকা দামে ডাব কিনে ব্যপারীরা। অথচ ওই বাজারের বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। অথচ আমরা গাছের মালিকরা ন্যার্য দাম পাই না। আমরা ব্যাপারীদের এসব কথা বললে বা কম দামে ডাব কিনতে না চাইলে তারা চলে যায়। আবার অন্য ব্যাপারীরাও ওই দামের বেশি দিতে চায় না। আর বেশি দিন ডাব গাছে রাখলেও সমস্যা। তাই বাধ্য হয়ে তাদের দামে অথাৎ কম দামেই ডাব বিক্রি করে থাকি।
মনপুরা ইউনিয়নের তুলাতুলি গ্রামের কৃষক মো: মোশারফ ও মোঃ শাহে আলম জানান, মনপুরার ব্যাপারীরা সিন্ডিকেট করে আমাদের থেকে কম দামে ডাব ক্রয় করে ঢাকার পাইকারী বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। আমরা যদি ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করতে পারে তাহলে আমরা অনেক বেশি লাভবান হতে পারি। কিন্তু এক সাথে বেশি ডাব বিক্রির উপযোগী হয় না। তাছাড়া বেশি পরিমাণ না নিয়ে গেছে ঢাকা খরচ দিয়ে পোষবে না। তাই ওদের কাছে যেনে বুঝেই বিক্রি করে থাকি।
মনপুরার ডাবের পাইকারী ব্যাপারী মোঃ আকরাম ও মো: জাহাঙ্গীর ব্যাপারী জানান, তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ডাব মনপুরা থেকে ক্রয় করে ঢাকায় পাইকারী আড়তে বিক্রির করেন আসছেন।  প্রতি বছর চৈত্র মাস থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত ডাব মনপুরার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাম গ্রামে গিয়ে ডাব গাছের মালিকদের কাছ থেকে ক্রয় করে থাকেন। মনপুরা উপজেলায় বর্তমানে তার মত সব মিলে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জনের অধিক পাইকার আছে। কেউ দৈনিক ডাব ক্রয় করেন, কেউ সপ্তাহে আবার কেউ মাসে ক্রয় করেন। মো: ইমন হোসেন জানান, তারা ডাব গাছের মালিকদের কাছ থেকে ৫০ টাকায় ডাব কিনে লোজকন দিয়ে গাছ থেকে পাড়ান। এরপর অটোররিক্সা ও ভ্যান নিয়ে লঞ্চ ঘাটে নিয়ে যাই। পরে লঞ্চ ও স্টিমারের করে ঢাকা সদর ঘাটের পাশের পাইকারী আড়ত পাঠাই। ওই পর্যন্ত পাঠাবে শ্রমিক, অটোরিক্সা, ভ্যান, লঞ্চ বা স্টিমার ভাড়া মিলে ১৪ থেকে ১৮ টাকার মত খরচ পরে যায় প্রতি পিস ডাবে। অথাৎ কৃষক থেকে ৫০ টাকা কিনলেও সেটি প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ টাকা পরে যায়। পরে পাইকারী আড়তে আমরা ৮০ থেকে সর্ব্বোচ ১০০ টাকা বিক্রি করতে পারি। তাদের থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় খুচরা বিক্রেতারা। আমরা আড়তে বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতারা সর্ব্বোচ ৫ টাকা বেশি দাম ক্রয় করে বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি করে থাকে ।
তিনি আরো জানান, তিনি আরো জানান, স্থানীয় মনপুরা ও ভোলার শহরের ডাবের দাম তেমন একটা পাওয়া যায় না। এবং ক্রেতার সংখ্যাও তেমন একটা নাই। তাই আমরা ঢাকার পাইকারী আড়তেই বিক্রি করে দেই।
আরেক ব্যাপারী মো: আলা উদ্দিন জানান, ঢাকায় বাজারে আমাদের ভোলার ডাবের চাহিদা সব চেয়ে বেশি। একারণে আমাদের ডাব ৮০ থেকে ১০০ টাকা দামে বিক্রি করতে পারি। কারণ ভোলার ডাব মিষ্টি ও খেতে অনেক সুস্বাদু।
তিনি আরো জানান, খুচরা বাজারে ডাবের দাম বেশি হলেও আমরা বেশি দাম আড়তদার থেকে দাবী করতে পারি না। কারণ আমরা প্রতি বছরই ঢাকার পাইকারী আড়তদার থেকে দাদন এনে ব্যবসা করি। শীত মৌসুমে ওই দাদনের টাকা আমাদের সাথে কাজ করা শ্রমিকদের দাদন দেউ আবার কখন কখন গাছ মালিক বা কৃষকদেরও দাদন দেই। এ কারণে আমরা আড়তদার থেকে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে পারি না।
মনপুরা উপজেলার কবি ও সাংবাদিক সীমান্ত হেলাল জানান, প্রতি বছরই মনপুরা থেকে লাখ লাখ ডাব রাজধানী ঢাকার পাইকারী আড়তদের বিক্রি হয়ে থাকে। মনপুরার ডাব সুস্বাদু হওয়ার এটির চাহিদা ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষের কাছে বেশি। স্থানীয় খুচরা বাজার দাম কম থাকায় বেশিভাগই ঢাকার পাইকারী আড়তে চলে যায়।
তিনি আরো জানান, আগে এক পিস ডাব ব্যাপারীরা কিনতো ১৫ থেকে সর্ব্বোচ ২৫ টাকা। কিন্তু গত দুই বছর ডাবের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা নারিকেল গাছ লাগানোর দিকে ঝুকছে। এতে করে মনপুরার কৃষকরা যেমন অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন তেমনি মনপুরার আর্থিক উন্নয়নও হচ্ছে। এছাড়াও গাছের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রকৃতির সৌন্দর্যও বেড়ে যাচ্ছে।
ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: খায়রুল ইসলাম মল্লিক জানান, জেলার সাত উপজলার কৃষকরা নারিকেল গাছ লাগানোর দিকে ঝুকছে। আমরা তাদের উৎসা দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও গত অর্থ বছরের আমরা প্রনোদনা কর্মসূচির আওতায় ৬ হাজার নারিকেল গাছের চারা দিয়েছি। এবছরও আমরা দিবো।
তিনি আরো জানান, বর্তমানে জেলার সাত উপজেলায় ১৫ লাখ ৮০ হাজার ৮শ' নারিকেল গাছ রয়েছে। গত অর্থ বছরে ১১ কোটি ৬ লাখ ৫৬ হাজার শ' নারিকেল উৎপাদিক হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মনপুরা ও চরফ্যাশন উপজেলায়।