অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, রবিবার, ২৮শে ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৩ই পৌষ ১৪৩২


এক দ্বীপের অন্তর্লিখন সাংবাদিকতার মহীরুহ এম. হাবিবুর রহমান


বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৯শে নভেম্বর ২০২৫ বিকাল ০৫:২৭

remove_red_eye

১৫৩

মোঃ মহিউদ্দিন : উপকূলের দ্বীপভূমি ভোলা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভাঙন আর বঞ্চনার অভিঘাতে যে জনপদ বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, সেখানে জন্ম নিয়েছিলেন এক অসাধারণ মানুষ যিনি সারাটি জীবন কাটিয়েছেন মানুষের কথা তুলে ধরতে, নির্যাতিত জনপদের সত্য ইতিহাস দেশের সামনে পৌঁছে দিতে। তিনি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ সাংবাদিক, ‘হাবি রিপোর্টার’ নামে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এম. হাবিবুর রহমান।


জন্ম ও শেকড়ের গল্প :
১৯৪৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ভোলা সদরের ঐতিহ্যবাহী চরনোয়াবাদ সিকদার বাড়িতে তাঁর জন্ম। বাবা সেকান্দার আলী সিকদার উপকূলের অন্যতম নামকরা মহাজনি ব্যবসায়ী। ধান, সুপারি, নারকেল, মরিচ ভোলার প্রধান কৃষিজ পণ্যের এই বড় ব্যবসায় তিনি তখন জেলার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। মা সায়েদা খাতুন এক শিক্ষণীয় চরিত্র, স্নেহময়ী, শৃঙ্খলাপরায়ণ।ছয় ভাই ও দুই বোনের পরিবারে এম. হাবিবুর রহমান ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। নিজ সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে।
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী, শান্ত, কৌতূহলীÍএবং একই সঙ্গে এক দুর্দান্ত ফুটবলার। মাঠের খেলা তাঁকে শিখিয়েছে নেতৃত্ব, আত্মবিশ্বাস ও দলগত মনোভাব।


শিক্ষার আলোয় প্রসারিত ভবিষ্যৎ:
পড়াশোনায় উজ্জ্বল ছিলেন অতি প্রাকৃতিক প্রতিভা নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলফলক। সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি পরিচিত হন দেশের-সমাজের বাস্তব রাজনীতির সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুনামের সঙ্গে এম.এ. পাস করেন তিনি।
সাংবাদিকতা: সত্য বলার শপথ ১৯৬৭ সাল তৎকালীন স্বনামধন্য দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় নিয়োগ লাভের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাংবাদিকতার মহাযাত্রা। ভোলার মতো দুর্গম দ্বীপ থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন পাঠানো ছিল তখন এক দুরূহ চ্যালেঞ্জ। তবুও তিনি থামেননিÍকারণ মানুষের জীবনের কথা বলা ছিল তাঁর নেশা, দায়িত্ব, প্রতিশ্রুতি। তিনি কখনো সংবাদ সংগ্রহ করতে যাননি তিনি যেতেন মানুষের কাছে। 
চায়ের দোকানে, নদীর ঘাটে, চরবাসীর উঠোনে সব জায়গায় তিনি ছিলেন মানুষের আশ্বাসের নাম: “হাবি রিপোর্টার এলে কথা বলা সহজ হয়।”
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় যে খবর বদলে দিয়েছিল ইতিহাস, ১২ নভেম্বর ১৯৭০। 
বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় উপকূলকে গ্রাস করল। ভোলা, মনপুরা, তজুমদ্দিন সমগ্র অঞ্চল হয়ে গেল এক মৃতপ্রায় জনপদ। এম. হাবিবুর রহমান মৃত্যুর স্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে লিখলেন সেই কালজয়ী রিপোর্ট “কাঁদো বাঙালি কাঁদো, ভোলার গাছে গাছে ঝুলছে লাশ।” পূর্বদেশ-এর প্রথম পাতায় আট কলামে প্রকাশিত হয় তাঁর পাঠানো সেই প্রতিবেদন। মানবতার আর্তনাদ হয়ে তা ছুটে যায় দেশ-বিদেশে। পিআইবির আর্কাইভে আজও সংরক্ষিত সেই সংবাদ। এমন রিপোর্ট শুধু খবর ছিল না ছিল বাঁচার জন্য আকুতি, ছিল ইতিহাসগঠনের দলিল। ভোলার মানুষকে উদ্ধারে দেশি-বিদেশি সংস্থা ছুটে আসে তাঁর সেই প্রতিবেদের পর। 


মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা:
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
তখনো তিনি কলমের সৈনিক কিন্তু সেই কলমই হয়ে ওঠে অস্ত্র।
ভোলার ওয়াপদা কলোনীতে গণহত্যার চোখধাঁধানো চিত্র তিনি ধারণ করেন প্রতিবেদনে
“মরণপুরী ভোলা ওয়াপদা কলোনী।”
এই সাহসিকতা তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়। এ রিপোর্ট তাঁর নামকে প্রতিষ্ঠা দেয় উপকূলীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায়। 
দীর্ঘ পেশাজীবন সাংবাদিকতার বাতিঘর:
৬০ বছরের সাংবাদিকতা জীবন যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। তিনি ছিলেন, ভোলা প্রেসক্লাবের ৯ বার সভাপতি, ৮ বার সাধারণ সম্পাদক। 
১৯৯৪ সালে তাঁর সম্পাদনায় দৈনিক বাংলার কণ্ঠ প্রকাশিত হয় যা ভোলার সাংবাদিকতার বাতিঘর হয়ে ওঠে। ৩০ বছর ধরে দৈনিক বাংলার কণ্ঠ-এর সম্পাদক, বাংলাদেশ বেতারের দীর্ঘদিনের ভোলা জেলা প্রতিনিধি, উপকূলীয় রিপোর্টিং এর পথিকৃৎ ; মানুষ ও মানবতার সংবাদদূত।


জাতীয় স্বীকৃতি ও সম্মাননা : 

১৯৮৫ ঢাকাগামী এমভি সামিয়া লঞ্চডুবির খবর সর্বপ্রথম প্রকাশ করায় রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। 
১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় ও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত রিপোর্টিং-এর স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২২ সালে পেয়েছেন বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড যা সাংবাদিকতা জগতে অতুলনীয় সম্মান, মানুষের ভালোবাসা এবং নন্দিত মর্যাদা। 
শেষ প্রহর এক দিগন্তের অবসা: তিনি ২৪ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ঢাকার পিজি (চএ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল ৩ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। 
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৫ বছর।
২০ নভেম্বর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নেন।
ভোলার মানুষের বলা সেই কথাটি আজ আরও গভীর সত্য হয়ে দাঁড়ায়
“হাবি রিপোর্টার না থাকলে ভোলার গল্প কে বলবে?”
উপসংহার: এক জীবন্ত অভিলেখের বিদায় এম. হাবিবুর রহমান শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না তিনি ছিলেন ভোলার চলমান ইতিহাস, মানুষের মনের কথার প্রতিধ্বনি, উপকূলের বেদনা ও আশার মুখপাত্র।
তিনি দেখিয়েছেন একজন মানুষ কিভাবে আজীবন সত্য বলা, মানুষকে ভালোবাসা এবং দায়িত্ব পালনকে জীবনের একমাত্র ধর্ম হিসেবে ধারণ করতে পারে। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর লিখিত শব্দ আছে, তাঁর উঁচু মানের নৈতিকতা আছে, তাঁর শেখানো পথ আছে। 
ভোলার বাতাসে, নদীর ঘ্রাণে, চরবাসীর স্মৃতিতে হাজার জীবনের রোদ-বৃষ্টি মেখে তিনি থেকে যাবেন চিরকাল। পরিশেষে আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।
আর ভোলার সাংবাদিকতা যেন তাঁর দেখানো সত্য-সাহসের পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারে।


লেখক : কবি, সাহিত্যিক, সিনিয়র লেকচারার


ভোলা জেলা মোঃ ইয়ামিন ভোলা সদর