কম ফলন অর্ধেক দাম
নেয়ামত উল্যাহ : কম খরচে ভালো ফলন, ভালো দামের আশায় ভোলার কৃষকরা সয়াবিন চাষে ঝুঁকে এবার বিপাকে পড়েছেন। একদিকে সয়াবিনের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে মৌসুমের শুরুতে কম অঙকুরোদম ও প্রচন্ড খরা থাকাসহ আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় আশানুরূপ ফলন হয়নি। এসব কারণে সয়াবিন চাষীদের ক্ষতি গুনতে হচ্ছে বলে জানা যায়। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এরকম তথ্য উঠে এসেছে।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ভোলায় এ বছর ১৫হাজার ৯০৮হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, ভোলার চর-চরাঞ্চল, নিচুজমি, নদীর তীর ও পরিত্যাক্ত জমিতে সয়াবিন চাষ করছে। কৃষকরা জানায়, বিগত দিনগুলোতে কম কষ্টে কম সারে সয়াবিন আবাদে কৃষকের যেমন বেশি লাভ হয়েছে, তেমনি ক্ষতির সন্মুখীন হয়নি বললেই চলে। ধরা যায় নিশ্চিত লাভের ফসল ছিল এটি। ফিড শিল্পের কারণে গত ২০ বছরের মধ্যে সয়াবিনের আবাদ দিনে দিনে বাড়ছে। কিন্তু দিনে দিনে উৎপাদন খরচ বাড়লেও বিক্রিমূল্য কমেছে প্রায় অর্ধেক।
ভোলার সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের কৃষক শাহাবুদ্দিন ফরাজি জানান, লাভ বেশির কারণে তিনি এ বছর ৩৫একর জমিতে সয়াবিনের আবাদ করেছেন। কিন্তু পাকার পরে জানতে পারলেন দাম নেই। এখন তাঁর মাথায় হাত!
ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের চর টবগী গ্রামের কৃষক দুলাল মাঝি(৫০) জানান, তিনি আড়াই কানি (৪ একর) জমিতে সয়াবিন আবাদ করেছেন। এ জমিটুকু এক বছর আবাদের জন্য মালিককে সাড়ে ৬২হাজার টাকা দিতে হয়েছে। সে হিসাবে এক ফসলের জন্য জমি খরচ পড়েছে প্রায় ২০হাজার টাকা। জমিতে চাষ দিয়েছেন ১৭হাজার ৫০০ টাকার। ৩মন বীজ বুনেছেন ১২হাজার টাকার। সার ছিটিয়েছেন ৮০০টাকার। ওষুধ দিয়েছেন ৩হাজার টাকার। পাকা সয়াবিন কাটতে খরচ হয়েছে ২১ হাজার টাকা। মেশিন দিয়ে সয়াবীনের বীজ ছাড়াতে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বিক্রির উপযুক্ত করতে খরচ হয়েছে ৭৯ হাজার ৭৫০টাকা। ফলন হয়েছে মাত্র ৫৫মন। বেপারী একমন সয়াবিন ১হাজার ২০০টাকার বেশি দিচ্ছে না। তাতে বিক্রিমূল্য আসেছে ৬৬হাজার টাকা। দুলাল মাঝির ক্ষতি হচ্ছে ১৩হাজার ৭৫০টাকা। একরে সাড়ে ৩হাজার টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
দুলাল মাঝি বলেন, এ ৪একর জমিতে ফলন হওয়ার কথা কমপক্ষে ১০০মন। কিন্তু ৩০-৩৫শতাংশ বীজ অঙ্কুরোদগম হয়নি। এরপরে ফল যা হয়েছে প্রচন্ড খরার কারণে ফলের মধ্যে বীজ নেই। যা আছে তাও পুষ্ট হয়নি।
দুলাল মাঝি আরও বলেন, গত বছর সয়াবিনের মন ছিল ২ হাজার ২০০টাকা। মোকামে আরও বেশি। এ বছর তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হবে। এমন ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন কিভাবে জানতে চাইলে দুলাল মাঝি বলেন, ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি নিজে শ্রম দিচ্ছেন। নিজের স্ত্রী-সন্তান শ্রম দিচ্ছেন। বীজটি কিনতে হয়নি। ঘরে ছিল। সয়াবিনের খরগুলো বিক্রি যায় না ঠিক, তবে গরুর খাবার হয়। এভাবে ক্ষতি কাটিয়ে সমান সমান হলেও টিকে থাকবেন বলে জানান।
ইউনিয়নের চরপদ্মা গ্রামের সত্তুর বছরের বৃদ্ধা আয়েশা বিবির ৮ মেয়ে। তাঁর স্বামী-পুত্র নেই। এক মেয়ে বাক প্রতিবন্ধী। একজন আছে স্বামী পরিত্যাক্তা। গত ২০ বছর ধরে তাঁরা এক একর ৫২শতাংশ জমি বাৎসরিক লগ্নি নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। রবি মৌসুমে ওই জমিতে সয়াবিন চাষ করেছেন। কিন্তু শ্রমমূল্য বেশি হওয়ায় মেয়েরা বাড়িতে এসে মাকে সয়াবিন কেটে দিচ্ছেন। মেয়ে শেফু জাহান, রেবুজাহান, হালিমা আক্তার, বিবি ফাতিমা, জান্নাতুল ফেরদাউস জানান, এ বছর প্রচন্ড খরায় সয়াবিনের ফলন ভালো হয়নি। বদলা দিয়ে কাটতে গেলে খরচতো দূরে থাক বীজের দামও উঠবে না। তাই তাঁরা তাঁর মাকে সাহায্য করার জন্য বাড়িতে এসে সয়াবিন কেটে দিচ্ছেন।
ভালো দাম পাওয়ার আশায় গত বুধবার সয়াবিন শুকাতে দেখা যায় চর টবগী গ্রামের মো. কামাল শিকদারকে। তিনি ৩ একরে সয়াবিন আবাদ করেছেন। তার ফলন মোটামুটি অনেকের চেয়ে ভালো হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন,মজুদ করলে হয়তো পরে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু চরে মজুদ করতে গেলে ইঁদুর সব কেটে নষ্ট করে দেবে। তাই মজুদ না করে একটু শুকিয়ে বিক্রি করলে দাম ভালো পাবেন বলে জানান।
মদনপুর ইউনিয়নের ইউপিসদস্য ফারুক দৌলতসহ একাধিক সয়াবিন চাষী বলেন, বেপারীরা মদনপুর ইউনিয়নের সয়াবিনের কৃষকদের মৌসুমের শুরুতে আগাম দাদন দেন। একজন কৃষক ৫থেকে ৩০হাজার টাকা পর্যন্ত দাদন নিয়ে সার, ওষুধ, বীজ কিনে সয়াবিন আবাদ করেছেন। তাই কৃষকরা বাধ্য হয়ে বেপারীদের নির্ধারিত দামে সয়াবিন বিক্রি করছেন। অন্যদিকে চরাঞ্চলে সয়াবিন মজুদ করার জাগা নেই।’
সয়াবিন বেপারী আব্দুল আলী চৌকিদার বলেন, গত বছর তিনি সয়াবিনের মন কিনেছেন ২হাজার ২০০টাকায়। বিক্রি করেছেন আরও বেশি। এ বছর দাম প্রায় অর্ধেক কমে গেছে। এ বছর এক হাজার ২০০টাকা মন দরে কিনে এক হাজার ২৫০টাকা দরে বিক্রি করছেন। সয়াবিনের দাম কমে যাওয়ার অনেক কারণ বলেছেন মোকামের পাইকার। এক. ভারত থেকে ছেড়ে দেওয়া পানিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। ওই সময় ব্যপক পরিমান মাছ, মুরগী ও গবাদী পশুর খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সেগুলো এখনও দাঁড়াতে পারেনি। অন্যদিকে ৫আগস্টের পরে অনেক ফিড কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো এখনও চালু হয়নি। এসব কারণে সয়াবিনের দাম অর্ধেক কমে গেছে।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক এএফএম শাহাবুদ্দিন আবহাওয়া অনুকূলে না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর সয়াবিনের দাম অর্ধেকে নেমে যাওয়ার কারণে আমরা কৃষককে বলছি-ফসল শুকিয়ে মজুদ করে রাখতে। পরে দাম বাড়লে বিক্রি করবেন।