অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, বৃহঃস্পতিবার, ৩১শে অক্টোবর ২০২৪ | ১৬ই কার্তিক ১৪৩১


আমাদের বাতিঘর ইউসুফ স্যার


বোরহানউদ্দিন প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৫ই অক্টোবর ২০২৪ রাত ০৯:০১

remove_red_eye

৩১৪




 মোবাশ্বির হাসান শিপন : আমাদের বাতিঘর ইউসুফ স্যার। এ পৃথিবীর  চক্রবাক থেকে বিদায় নেন ২০১৮ সালের ১৭ আগস্ট দুপুর দেড়টায়। ইউসুফ স্যার চলে গেলেন অন্য ভুবনে কিন্তু এ ভূবনে রেখে যাওয়া সৃষ্টির মগজে,মননে,স্মরণে তাঁর ব্যাখ্যাতীত বিচরণ হচ্ছে;হবে। পেশাগতভাবে অনেকেই শিক্ষক হয়। তবে কেউ কেউ শিক্ষক হয়। কেউ কেউ’র মধ্যে তিনি একজন।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় ‘জীবন ছোট নয়, আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তাছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকিনা, হয় থাকি ভবিষ্যতে, নাহয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাই নাই। বর্তমান নিঃসন্দেহে অতীত আর ভবিষ্যতের একটা জীবিত ফাইল। থাকবেনা কিছুই, সবাই চলে যাবে। কিন্তু ওই যে আশ্চর্য মুহূর্তগুলো পাওয়া গেল, সেগুলোই জীবন। আমাদের সহস্র ক্রোশ দৌড়ানোর একটা মাইল ফলক।’
আমাদের জীবন ফাইলকে আলোকোজ্জ্বল করতে যাদের নিরন্তর ধ্যানের রাজ্য; তাঁরাই হচ্ছেন শিক্ষক। ইউসুফ আলী স্যার ছিলেন সেই ছুটে চলা ধ্যানীদের মধ্যে অসাধারণ একজন। শতবর্ষী বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের(বর্তমানে বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) গণিত পড়াতেন। বিজ্ঞান বিষয়েও ছিল তাঁর পান্ডিত্য। মানুষটার আপাদমস্তক ধমনী, শিরা-উপশিরার প্রতিটি রক্ত বিন্দুতে বহমান ছিল আলোকিত মানুষ গড়ার নিখাদ তাগিদ।
স্যার গণিতের ক্লাস নিতেন অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। তাঁর বিষয়ে কেউ ফেল করতে পারবেনা-এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি পড়াতেন। যারা একটু ভালো- তাদের তিনি আলাদা করতেন পাশাপাশি যারা দূর্বল ছিলো তাদের ঘষামাজার জন্য তাঁর আলাদা কেয়ার ছিলো । এজন্য স্কুল সংলগ্ন তাঁর বাসার দরজা সবসময় সবার জন্য ছিলো উন্মুক্ত। এটাকে প্রচলিত অর্থে প্রাইভেট পড়া বলা যাবেনা।


তাঁর কাছে বাসায় দিনের পর দিন পড়তে যায়নি- এমন কোন ছাত্র আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে সংখ্যাটা যে শূন্য হবে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। এজন্য স্যারের কোন নির্দিষ্ট চাহিদা ছিলোনা। ছিলোনা নিদিষ্ট দিন-ক্ষণ। চল্লিশোার্ধ অনেককে বলতে শুনেছি, বাড়ি থেকে পাঁচশ’ এনে স্যারকে দিতাম দেড়শ’। তাতে তাঁর কোন প্রশ্ন ছিলোনা। কে কত দিয়েছে- বা দেয়নি এটা তাঁর মাথায়ই ছিলোনা। বরং উল্টা বলতেন, ‘কাল থেকে পড়া মিস দিলে কিন্তু তোর বাবাকে জানাবো।’ খুব সম্ভবত স্কুল টাইমের বাইরে বিনে পয়সায় এতো ছাত্র আর কেউ পড়ায়নি। অবশ্য অভিভাবক টাকা থেকে ঠিকই আনা হতো,স্যার পর্যন্ত পৌঁছতো না।
সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা মনে রাখিনা, ভুলে যাই। কে ১০০ দিন রসগোল্লা খাইয়েছিল সেটা আমরা মনে রাখিনা, কিন্তু কে একদিন কান মুচড়ে দিয়েছিল তা মনে রেখে দিয়েছি। এমনই হয়।
স্যারের বাসা ছিলো নিরিবিলি। চারপাশে নানা ফলের গাছ। আমরা। মানে ’৯২ ব্যাচের আমি, আকবর, রুমু, মুজিব, মাহাবুব, ফয়সাল,সাইফুল লিটন,মনির স্যারের যে পরিমান ফল, ডাব, কন্ডাওয়ালা(নারিকেল চারার ভিতরের শাস)নারিকেল লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছি;ঐগুলোর হিসেব দিয়েই কুল পাবোনা। বাপের যেমন শান্তশিষ্ট ছেলে থাকে দুষ্ট ছেলেও থাকে। আমরা একটু বেশীই দুষ্ট ছিলাম। স্যার সব বুঝতেন। তিনি যে বুঝেছেন এটাও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতেন। বিষয়টা এমন যে,আমি বুঝেছি কিন্তু অংক বই আর খাতা নিয়ে আসতে হবে। কখনও বাসার সামনের সুপারী বাগানের ভিতর হোগলা বিছিয়ে কখনও ঘরের মধ্যে গাঁদাগাঁদি করে ক্লান্তিহীন পাঠদান। কারো শেষ; কারো শুরু। সংখ্যা কিন্তু কমতো না। অবাক লাগে মানুষের এতো ধৈর্য হয় ক্যামনে! বছর নয়েক আগের কথা। স্যারের তখন স্মৃতিশক্তি ভালোই। দুপুর দুইটা। স্যার ঈদগাহ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসার দিকে যাচ্ছেন। পাশে তাঁর ছোট ছেলে সুমন। পিছু নিয়ে বাসা পর্যন্ত গেলাম। স্যার বসলেন। আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়লাম।
কীরে উঠে বস।
না স্যার ঠিক আছে।
আস্তে বললাম স্যার ছাত্রাবাসে থাকার সময় আপনার দুষ্ট পোলারা অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছে। আপনার ফলমুল অনেক কিছু খেয়ে ফেলেছে। আপনি আমার মাথায় হাত রেখে বলেন,মাপ করেছেন। নাহলে আমি পা ছাড়ছি না। স্যার মাথায় হাত রেখে বললেন, দূর বোকা ঐগুলোতো খাওয়ার জন্যই! এবার ওঠ।
মনে পড়ে ফজরের ওয়াক্তে  স্যার রুমের দরজায় কড়া নাড়ত প্রতিদিন। হাঁক ছাড়তেন, ‘ওঠ নামাজের সময় হয়েছে!’ আমরা না শুনি না শুনি করে শুয়ে থাকতাম। স্কুল টাইমে লেইজারের সময় বেত ঘুরিয়ে ভবনের এ মাথা থেকে শেষ মাথায় টহল দিয়ে ছাত্রদের মসজিদে ঢুকাতেন। খুব সম্ভবত এটা বড়সর মাদ্রাসায় দেখা যায়না।
আমার প্রয়াত বাবা মোফাজ্জল হোসেন ছিলেন স্যারের কলিগ। বাবা ছিলে ইংরেজির শিক্ষক।  স্যার আর আমার বাবা প্রায় একই প্রকৃতির। একসাথে দুইজনে সোনালী সময়গুলো একসাথে পার করেছেন। কেউ কারো বিরুদ্ধে একটা মন্দ কথা বলতে শুনিনি। ওপারে অ-নে-ক ভালো থাকুন স্যার।

লেখক: শিক্ষক,সংগঠক,সাংবাদিক।