অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, বৃহঃস্পতিবার, ৩১শে অক্টোবর ২০২৪ | ১৬ই কার্তিক ১৪৩১


কোড়ালীয়া গ্রামে ফণীর তান্ডব


বাংলার কণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ৫ই মে ২০১৯ রাত ০১:০৭

remove_red_eye

৬৬৩

হাসিব রহমান ॥ ভোলার উপর দিয়ে শুক্রবার রাতে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ফনীর তান্ডবে ভোলা সদরের দক্ষিন দিঘলদী ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া নদীর তীর সংলগ্ন কোড়ালিয়া গ্রাম লন্ড ভন্ড হয়ে গেছে। ঝড়ের তান্ডবে এ সময় গাছ চাপা পড়ে রানী বেগম (৫০) নামের এক গৃহবধু নিহত হয়েছে। এছাড়াও  অন্তত ২৫ জন আহত হয়। অপর দিকে ঘূর্ণিঝড় ফনির প্রভাবে জোয়ারের পানিতে ডুবে ভোলার লালমোহন উপজেলায় এক শিশু নিহত হয়েছে। এ নিয়ে ভোলায় নিহতের সংখ্যা দাড়ালো ২ জন। একজন শিশু ও এক জন নারী। এছাড়াও  শতাধিক গবাধি পশুর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে  বিধ্বস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ভোলা জেলার ঝড়ে অন্তত ৭ শতাধিক ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ভোলা সদরে দের শত, লালমোহনে প্রায় এক শত, তজুমদ্দিনে প্রায় ৩ শত,মনপুরায় একশ,চরফ্যাসনে প্রায় একশত ঘরের ক্ষতি হয়েছে।  এদিকে ভোলার আশ্রয় কেন্দ্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে খিচুড়ি ও ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে শুকনো খাবার এবং নিহতের পরিবারকে নগদ অর্থ বিতরন করা হয়েছে।

ভোলার দক্ষিন দিঘলদীর নিহত রানী বেগমের স্বামী সামসল হক জানান, রাতে তিনি স্ত্রী পুত্র নাতিসহ ৬ জন অবস্থান করছিলো। রাত ৩ টার দিকে ঝড় শুরু হয়। ভোর ৪ টার দিকে হঠাৎ করে তেঁতুলিযা নদী থেকে আলোর মতো ঘুনি বাতাস আসে। প্রায় এক মিনিট স্থায়ী এই বাতাসে তার ঘর ভেঙ্গে পড়ে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা রক্ষা পেলেও আমসল হকের স্ত্রী রানি বেগমকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তিনি ঘরের নিচে চাপা পড়ে ঘটনা স্থলেই মারা যান। নিহত রানী বেগমের ৩ ছেলে ৩ মেয়ে। এর মধ্যে বাক প্রতিবন্ধি একটি  কন্যা রয়েছে। ওই পরিবারটি এখন খোলা আকাশের নিচে বসবসা করছে।  এই ইউনিয়নের বটতলা সহ বিভিন্ন স্থানে বহু ঘর বাড়ি গাছ পালা বিধ্বস্ত হয়েছে।

সরেজমিনে কোড়ালিযা গ্রামে প্রবেশর পর রাস্তার দুই পাশে যেদিকে চোখ যায় যেন বিধ্বস্ত এক জনপদ। ঝড়ের ভয়াবহতা এতোই ছিলো যে   বিদ্যুতের খুটি পর্যন্ত ভেঙ্গে  টুকরো করে ফেলে। ভোলার দক্ষিন দিঘলদী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান  ইফতেখারুল আলম স্বপন জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় দের শত ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে নিহতের পরিবারকে তিনি ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পরবর্তীতে সহায়তা করা হবে বলে জানান। ভোলার দক্ষিন দিঘলদী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক কামাল হোসেন জানান, তাদের দলীয় কর্মীরা সকাল থেকে দুর্গত এলাকার মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। তাদের সহায়তায় পাশে দাড়িয়েছেন। এদিকে  ভোলা পুলিশ সুপার মো: মোকতার হোসেন বিধ্বস্ত জনপদ পরিদর্শশন করে  জানান, তিনি শুক্রবার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে মানুষের খোঁজ খবর নিয়েছেন। যেসব পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি তাদের মধ্যে একটি পরিবারের এক নারী নিহত হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে। অপরদিকে দুপুরে কোড়ালিয়া গ্রামে ক্ষত্রিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরন করা হয়।

 

চরফ্যাসন উপজেলার সাগর মোহনার ইউনিয়ন ঢাল চরের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম জানান, তার এলাকায় অন্তত অর্ধশতাধিক ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে। সেখানে অতিজোরের পানিতে ৪২ পুকুরের মাছের ক্ষতি হয়েছে। এতে অন্তত অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

অপর দিকে ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক ঘটনা স্থল পরির্দশন করে সাংবাদিকদের জানান, তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ঘর নির্মান করে দেয়া হবে।  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পূর্বের চাইতে ভাল করে দেয়া হবে।  এছাড়া নিহত পরিবারকে তাৎক্ষনিক নগদ ২৫ হাজার  টাকা বিতরন করা হয়েছে। এছাড়াও বিকালে ভোলা সদরের গুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে আসা প্রায় আড়াই শত  নারী শিশু ও পুরুষের মধ্যে রান্না করা খিচুড়ি জেলা প্রশাসক বিতরন করেন।

তজুমদ্দিন প্রতিনিধি জানান, ভোলার তজুমদ্দিনে ঘূর্ণিঝড় ফণির আঘাতে ঘরবাড়ি, জমির ফসল,কাঁচারাস্ত, বেড়িবাধসহ গাছপালা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহি কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শণ করে খোজ খবর নেন।

প্রকল্প বাস্তবায় কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে ঘূর্ণিঝড় ফণির আঘাতে তজুমদ্দিন উপজেলায় ২শত ৮০টি কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া ৫শত ৭০ একর ফসলি জমির ফসল, ২০ কি.মি কাঁচা রাস্তা, ৫কি.মি বেড়িবাঁধ ও ১শত ৩০ একর জমির গাছপালা আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার দাস বলেন, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সি.পি.পি সেচ্ছাসেবকরাও ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতিতে অংশ নেয়। উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোশারেফ হোসেন জানান, মসজিদ মাদ্রাসাসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ বছর ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতি ও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা থাকায় জান-মালের তেমন ক্ষতি হয়নি।

লালমোহন প্রতিনিধি জসিম জনি জানান, ভোলার লালমোহন উপজেলায় ঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে লালমোহনের খাল বিল টইটম্বুর হয়ে যায়। এতে করে শনিবার সকালে চরভূতা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডে মোঃ জসিমের ৬ বছরের শিশু হাসানের খালে ডুবে মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেছেন লালমোহন উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল হাসান রুমি। খবর পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দিন আহমেদসহ তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শিশুর পরিবারকে শান্তনা দেন। এছাড়া মেঘনা নদীর তীরবর্তী মঙ্গলসিকদার ও লর্ডহার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ফাতেমাবাদ ¯øুইজে গিয়ে শিশু ও নারীদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন ইউএনও হাবিবুল হাসান রুমি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা অপূর্ব দাস জানান, লালমোহনে ঘূর্ণিঝড় ফনির প্রভাবে ৯০টি কাঁচা ঘর আংশিক ও ২২টি ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মাদ্রাসা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭টি এবং আংশিক ১৫টি, স্কুল সম্পূর্ণ ৫টি এবং আংশিক ২২টি। এছাড়া মঙ্গলসিকদার কৃষি ব্যাংক ভবনের চাল উড়ে গেছে।

মনপুরা প্রতিনিধি জানান,  মনপুরা থেকে বিচ্ছিন্ন কলাতলীর চর ও চরনিজামের নি¤œাঞ্চল এলাকায় ৩ ফুট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। এছাড়াও ফণীর তান্ডবে উপজেলার ৪ টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক বাড়ি-ঘর’সহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও বিচ্ছিন্ন চর নিজামে শতাধিক গবাধি পশুর মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরনবী সাংবাদিকদের জানান। এছাড়াও রাতভর ফণীর তান্ডবে উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের দাসেরহাট এলাকায় জীন রফিকের বাড়ি, মৎস্য ঘাটের সালাউদ্দিনের মৎস্য আড়ত, হানিফ হাজীর বাড়ি, আঃ মালেকের বাড়ি, বাবুল মাতাব্বরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান,অফিসার্স ক্লাব, রফিকের বাড়ি, মনপুরা ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন কলাতলীর চরে কবির বাজারের হাসান পাটোয়ারীর দোকান, গিয়াস উদ্দিনের বাড়ি, ৩ নং উত্তর সাকুচিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন চরনিজামে মোঃ রফিক, হোসেন, আলমগীর, নবাব, কামরুল, মনজু, সেকান্তর, রাজীব, ইউসুফ, জাহাঙ্গীর ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের মোস্তফা, বাবুল পিটার, হারুনের ঘরসহ শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়।

এদিকে চরনিজামের কৃষক হারুন, সুমন ও বাবুলের শতাধিক ভেড়া ও ছাগলের মৃত্যু হয়। এছাড়াও উপজেলার মাষ্টার হাটের পশ্চিম পাশের বেড়ীবাঁধ, দক্ষিণ সাকুচিয়ার সূর্যমূখী বেড়ীবাঁধ, হাজিরহাট ইউনিয়নের সোনার চর বেড়ীবাঁধ হুমকীর মুখে রয়েছে। যে কোন সময় বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে বির্স্তীন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।

ফণীর তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো সরজমিনে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বশির আহমেদ পরিদর্শন করেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মাঝে ত্রান বিতরন করেন। এছাড়াও তিনি বিচ্ছিন্ন মহাজনকান্দি এলাকা থেকে লোকজন ছরিয়ে এনে চরকৃঞ্চপ্রসাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। সেখানে পর্যাপ্ত ত্রান বিতরন করেন।

মনপুরা ত্রান ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা মোঃ আনিসুর রহমান জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজনদেরকে মাঝে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানদের ক্ষয়-ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে।