অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, রবিবার, ২৮শে ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৩ই পৌষ ১৪৩২


৪৫ বছর পর মাকে খুঁজে পাওয়া ভোলার কুলসুম যেভাবে হলেন সুইজাল্যান্ডের ম্যারিও


বাংলার কণ্ঠ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩শে এপ্রিল ২০২২ রাত ১১:৩৩

remove_red_eye

৪২১


জুয়েল সাহা বিকাশ :  ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের চটিয়া গ্রামের ফকির বাড়ি মোঃ ইউসুফ হোসেন ছিলেন কুলসুম বা ম্যারিও সিমো ভ্যামৌর  বাবা। ইউসুফ হোসেন পেশায় একজন গ্রাম কবিরাজ ছিলেন। গ্রামের হাট-বাজারে ঔষধ বিক্রি করে চার মেয়ে-দুই ছেলে ও স্ত্রী চলতো তার সংসার। খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিলো না তিনি। তারপরও সংসারে ছিলো সুখ। কিন্তু সেই সুখ আর বেশি দিন টিকলো না। ১৯৭৩ সালের দিকে হঠাৎ অজানা রোগে মারা যান ইউসুফ হোসেন। এরপর ছয় সন্তানের নিয়ে বিপাকে পরে স্ত্রী মাফিয়া বেগম। তখন মাফিয়া বেগম তার সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাছিলেন। পরে তার ছোট দেবর মোঃ আব্দুল রব মাফিয়া বেগম ও তার সন্তানদের নিয়ে যান রাজধানী ঢাকায়।
কুলসুমের চাচা মোঃ আব্দুল রব জানান, তিনি স্বাধীনতার পর ঢাকায় একটি বিস্কুট ফেক্টরিতে চাকরি করতেন। তার বড় ভাই ইউসুফ মৃত্যুর ৮ দিন পর গ্রামের বাড়ি একজনের সাথে দেখা হলে তিনি জানান বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর। খবর পেয়ে ছুটে যান গ্রামের বাড়ি। ততক্ষতে ১ মাস পার হয়ে যায়। আর গিয়ে দেখেন তার ভাভী মাফিয়া বেগম ছয় সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে কাটাচ্ছেন। পরে তিনি তাদের বাজার করে দিয়ে আবারও ঢাকায় চলে যান। এর ১ বছর পর তিনি ভাভী মাফিয়া বেগম ও তার ছয় সন্তানদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরের কাটপট্টিতে ৩০ টাকা একটি বাসা বাড়ি ভাড়া করেন। পরে অভাবের কারণে মাফিয়া বেগম তার বড় দুই মেয়ে মিলন বেগম ও নিলুফা বেগম বাসা বাড়িতে কাজে দেন। এবং দুই ছেলেকেও দোকানে কাজে দেয়। তারপরও ঠিকমত খেতে না পারায় স্থানীয় লোকজনের কথামত কুলসুম ও ছোট মেয়ে সমনেহা (সুমি) বর্তমানে সুইজাল্যান্ডের নাম সুজান সুজি’কে মোহাম্মদপুরে এফএফসি নামে একটি এতিমখানায় দেন। তখন কুলসুমের বয়স ৬/৭ বছর ও সমনেহার (সুমি)র বয়স ৩ বছর। এতিমখানায় দেওয়ার ৩/৪ দিন পর কুলসুম পালিয়ে আসে মায়ের সাথে দেখা করতে। পরে এতিমখানার দুই নারী এসে তাদের নিয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, আমার ভাজতী কুলসুম ও সমনেহাকে যে ভাভী এতিমখানা দিয়েছে সেটা আমি জানিনা। পরে আমি যানতে পেরে ভাভীকে নিয়ে প্রতি শুক্রবার দেখতে যাই। প্রায় ৩/৪ মাস পার হয়ে যায়। পরে একদিন শুক্রবার আবার আমরা তাদের দেখতে গেলে সেখানে আর তাদের দেখতে পাইনি। এরপর আর খুঁজেও কোন সন্ধান পায়নি।
যেভাবে ভোলার গ্রামের মেয়ে কুলসুম ম্যারিও সিমো ভ্যামৌ ও সমনেহা সুজান সুজি হলেন : ১৯ জুলাই  ১৯৭৭ সালে ওই এতিমখানা থেকে টিডিএইচ নামে একটি সংস্থ্যা কুলসুম ও তার ছোট বোন সমনেহাকে দত্তক নেয় সুইজাল্যান্ডের বার্থথ্যালেন ও তার স্ত্রী। পরে সুইজাল্যান্ডে গেলে তা পালিত বাবা-মা কুলসুমের নাম দেয় ম্যারিও ও সমনেহার নাম দেয় সুজান সুজি। তাদের বিয়ের পর স্বামীর নামের টাইটেল বলে যায় তাদের নামের পাশে।
যেভাবে আবার বাংলাদেশে ফিরে মা ও ভাই বোনদের খুঁজে পেলেন কুলসুম ঃ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের পিন্টু আক্তার নামে এক প্রবাসীর সাথে পরিচয় হয় ম্যারিও’র সাথে। ম্যারিও জানতে পারে পিন্টু আক্তার একজন বাংলাদেশেী। আর তখনই ম্যারিও পিন্টু আক্তারকে জানান সে একজন বাংলাদেশী। এবং তার সুইজাল্যান্ডের আসার ও বাংলাদেশের শিশুকালের কিছু কথা বলেন। এবং সে বাংলাদেশে থাকা তার মা ও পরিবারের কাছে যেতে আগ্রহী হন। এরপর পিন্টু আক্তার ঢাকার সাংবাদিক মনজুরুল করিমের সাথে বিষয়টি সেয়ার করেন। পরে ওই সাংবাদিকের সাথেও কথা বলিয়ে দেন। এরপর মনজুরুল কবির কুলসুমকে নিয়ে প্রতিবেদন করেন। এরপর ২০২১ সালেল শুরুর দিকে মায়ের সন্ধানে বাংলাদেশে আসেন কুলসুম। এরপর ওই সাংবাদিক কুলসুমকে নিয়ে করেন আরেকটি প্রতিবেদন। আর ওই প্রতিবেদন এবছর জানুয়ারি মাসে চোখে পরে কুলসুমের পরিবারের। এরপর যোগাযোগ করেন ওই সাংবাদিকের সাথে। পরে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এবং ডিএনএ রিপোর্ট করিয়ে প্রায় ১৫ দিন আগে মায়ের কাছে ফিরেন কুলসুম। আর কয়েকদিন পর মা ও পরিবারের কাছে আসানে সুইজাল্যান্ডের থাকা কুলসুমের ছোট বোন সুজান সুজি। আর র্দীঘ ৪৫ বছর পর কুলসুম ও সমনেহাকে পেয়ে আনন্দিত তার মাসহ পরিবারের সকল সদস্যরা।
যেভাবে গ্রামের বাড়ি ভোলায় ফিরলেন কুলসুম : ছোট বেলায় অভাবের কারণে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের নং ওয়ার্ডের চটিয়া গ্রামের ফকির বাড়ি থেকে ঢাকায় চাচার সাথে আসার কথা কিছুটা মনে আছে কুলসুমের। ওই থেকেই কুলসুমের পরিবার ঢাকায় থাকেন। কুলসুম পরিবারের সবাইকে ফিরে পেয়ে এবার কুলসুমের মনে পরেছে তার শিশুকালের গ্রামের বাড়ির কথা। কিন্তু সে মনে করতে পারছিলেন না সেটা কোথায়। পরে তার মায়ের কাছে গ্রামের বাড়ি কথা শুনে কুলসুম তার স্বামী সুইজাল্যান্ডের বাসিন্দা আন্দে সিমন ভারমুটকে নিয়ে গতকাল বুধবার (২০ এপ্রিল) ভোলার বোহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের চটিয়া গ্রামে ছুটে আসেন। সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত ছিলেন সেখানে। আর কুলসুম আসার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পরলে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসতে শুরু করে মানুষ। সকালে কুলসুম ও তার স্বামী গ্রামের বাড়ি পৌছালে তার পরিবারের সদস্যরা ফুল দিয়ে বরন করেন নেন তাদের। খুব ঘটা করেই কুলসুমের গ্রামের পরিবারের সদস্যরা বিদেশী জামাই ও মেয়েকে বরণ করেন। এরপর কুলসুম তার বাবার কবর জিয়ারত করেন। পরে দুপুর একটার দিকে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি।