অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, শনিবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৫ | ৬ই বৈশাখ ১৪৩২


সমাজে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কি বিপথগামী ! কারণ ও উত্তরণের উপায়


বাংলার কণ্ঠ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৮ই এপ্রিল ২০২৫ রাত ০৯:১৯

remove_red_eye

৬৫

 

মো: এরশাদ : তরুণ সমাজ একটি জাতির প্রাণশক্তি, পরিবর্তনের চালিকাশক্তি এবং ভবিষ্যতের কারিগর। তারা যদি সঠিক পথে থাকে, তবে একটি দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে আমাদের সমাজে তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নানা কারণে বিপথগামী হয়ে পড়ছে। তারা পড়াশোনা থেকে বিমুখ, নৈতিক অবক্ষয়ে জর্জরিত এবং ক্রমাগতভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ঝুঁকছে। এ অবস্থা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, জাতির অগ্রযাত্রাকেও বাধাগ্রস্ত করছে। এই অবস্থা জাতির ভবিষ্যতের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ।

 

বিপথগামিতার কারণসমূহ : 

তরুণদের বিপথগামী হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করে। প্রথমত, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের যথাযথ বিকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। বইপাঠ নির্ভর, পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা তরুণদের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারছে না। 

দ্বিতীয়ত; ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার তরুণদের সময় নষ্ট ও বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যাচ্ছে।

 তৃতীয়ত: অভিভাবকদের ব্যস্ততা, পরিবারে সময়ের অভাব, সমাজে নেতিবাচক প্রভাব এবং কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তাও তরুণদের হতাশ করছে। এর ফলে তারা মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধের দিকে ঝুঁকছে।

এখানে আমি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করতে পারি

ফিনল্যান্ড:

বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা ব্যবস্থা ফিনল্যান্ডে। সেখানে পরীক্ষার চাপ খুবই কম, ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতা বিকাশের ওপর জোর দেওয়া হয়। তরুণরা শিখতে আগ্রহী থাকে। কারণ তারা শিক্ষা ও জীবনের মধ্যে সরাসরি সংযোগ খুঁজে পায়।

 

জার্মানি:

জার্মানিতে শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। "ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম"-এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা স্কুলের পাশাপাশি শিল্প-কারখানায় কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করে, ফলে তারা খুব তাড়াতাড়ি কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে।

 

জাপান:

জাপানে শিক্ষার সাথে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের শিক্ষা সমানভাবে গুরুত্ব পায়। তরুণদের ছোটবেলা থেকেই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শেখানো হয়, যার ফলে তারা সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হয়।

 

ভারত:

ভারতের অনেক অঞ্চলেও তরুণদের বিপথগামিতার সমস্যা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং অনলাইন শিক্ষার প্রসার তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলছে।

 

বাংলাদেশে তরুণদের বিপথগামী হওয়ার মূল কারণসমূহ

১. শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ ও বেকারত্ব

জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (NYDI)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশ বেকার। অনেকেই উচ্চশিক্ষা অর্জন করেও কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। এর ফলে তরুণরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।

 

২. অপ্রাসঙ্গিক ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা : 

বর্তমান পাঠ্যক্রম অনেকাংশেই মুখস্থ নির্ভর এবং বাস্তবজীবনের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে তরুণরা শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।

 

৩. মাদক ও প্রযুক্তির অপব্যবহার

ডিজিটাল প্রযুক্তি যেমন সম্ভাবনার দরজা খুলেছে, তেমনি এর অপব্যবহার তরুণদের সময় নষ্ট, আসক্তি এবং অবাস্তব জগতের প্রতি আসক্ত করে তুলছে। এছাড়া মাদক গ্রহণের হারও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে।

 

৪. পারিবারিক অবহেলা ও সামাজিক বিপর্যয় :

আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় পরিবারে সময় ও সম্পর্কের ঘাটতি তরুণদের মানসিকভাবে একাকী করে তোলে। অনেকে বিকল্প ভালোবাসা বা আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অপরাধের পথ বেছে নেয়।

 

সমস্যা উত্তরণের উপায়

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

প্রথমত: শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা জরুরি। পাঠ্যক্রমে বাস্তবমুখী, প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মমুখী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাঠদান পদ্ধতি হওয়া উচিত প্রাণবন্ত ও শিক্ষার্থীবান্ধব।

দ্বিতীয়ত, তরুণদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা জরুরি—যেমন বিতর্ক, নাটক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এতে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে এবং তারা গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকে।

তৃতীয়ত, পরিবার ও সমাজকে তরুণদের পাশে থাকতে হবে। তাদের কথা শোনা, বোঝা এবং প্রয়োজনমতো সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চতুর্থত, তরুণদের মাদক ও অপরাধ থেকে দূরে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

পঞ্চমত, তরুণদের দক্ষ করে তুলতে প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় সুযোগ বাড়াতে হবে, যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।

তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের বিপথগামী হওয়ার অর্থ হলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হওয়া। তাই এখনই সময় পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার ও সমাজ সবাইকে একসাথে কাজ করার। তরুণদের মেধা, মনন ও সৃজনশীলতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারলেই গড়ে উঠবে এক আলোকিত, সুস্থ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

 

 

লেখক:প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ।