অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, রবিবার, ২৮শে ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৩ই পৌষ ১৪৩২


উপকূলের অদম্য সানজিদুল ইসলাম


চরফ্যাসন প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সন্ধ্যা ০৭:৪৭

remove_red_eye

৩৪২

এআর সোহেব চৌধুরী, চরফ্যাশন থেকে: ক্লাস সিক্সে পড়া অবস্থায় গ্রামের বন্ধুদের নিয়ে কিশোর কিশোর কিশোরী ক্লাব গঠন করেন। সেবছরই ইউনিসেফ থেকে "জীবন দক্ষতা বিষয়ক মৌলিক প্রশিক্ষণ" পান তিনি। তখন থেকেই সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা শুরু হয় তার। এসব কাজ তাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে, দেখিয়েছে নতুন কিছু সৃষ্টির স্বপ্ন বলছিলাম সানজিদুল ইসলামের কথা। ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় বাড়ি তার। উপকূলীয় এলাকায় জন্ম; দূর্যোগ ও দুর্দশা দেখে বড় হয়েছেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নতুন কিছু করার ইচ্ছা ছিল তার। সেই ইচ্ছার পূর্ণতাও দিয়েছেন। তার সমবয়সীরা যেখানে শুধু পড়ালেখায় ব্যস্ত থাকত সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি ভলান্টিয়ারিং শুরু করেন তিনি। শুরুতে ছবি, ভিডিও আর লেখালেখিতে উপকূলের কথা তুলে ধরতেন। সেই লেখা আবার ছাপা হত ইউনিসেফ এর শিশু সাংবাদিকতার সাইট হ্যালোতে। ছোট বেলায় সানজিদুল তার এলাকার নির্বাচিত শিশু এমপি ছিলেন। ইউনিসেফ আয়োজিত জাতীয় সংসদ এ "বাংলাদেশ প্রজন্ম সংসদ" এর ১ম অধিবেশনে ভোলা-৪ আসনের প্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি।
সানজিদুল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তার মত তরুন ও কিশোরদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছেন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তুলেন লিটল সিটিজেন্স নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। এই বয়সেই একটি সংগঠন এর নেতৃত্ব দিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয় সানজিদুল। সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে সাড়া দিয়ে ভোলায় জলবায়ু আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিকের পুনঃব্যবহার করা, নানারকম ক্যাম্পেইন কার্যক্রম করেছেন লিটল সিটিজেন্স এর হয়ে।
২০২০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ’ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ এর সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। প্রত্যন্ত গ্রাম, চরাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের সমস্যা গুলো বুঝতে চেয়েছেন, তা সমাধানে কাজও করেছেন তিনি। উপকূলীয় এলাকার স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে মডেল পুষ্টিবাগান তৈরির কাজও করেছেন তিনি ও তার টিম। উঠান বৈঠক, স্কুল ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে প্রজনন স্বাস্থ্য, শিশু সুরক্ষা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে কিশোর-কিশোরী, তাদের অভিভাবকদের সচেতন করার কাজ করছেন সানজিদুল। করোনার মধ্যেও থেমে ছিলনা তার কার্যক্রম। খাদ্য সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি মহামারীর বিস্তার রোধে সচেতনতার বার্তা প্রচার, হাতে তৈরি মাস্ক, ফেস শিল্ড, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরন করেছেন তিনি। তার বয়স ১৮ পেরিয়েছে, কিন্তু এখনও লিটল সিটিজেন হিসেবেই বেশি পরিচিত সবার কাছে। ২০২১ সালে প্রতিভাবান তরুন সংগঠক  হিসেবে "স্যার ফজলে হাসান আবেদ আশোকা ইয়াং চেইঞ্জমকার" নির্বাচিত হন। সানজিদুল তার কাজের সম্পূর্ণ ক্রেডিট দিয়েছেন তার টিমকে। তিনি বলেন, "একা কখনোই এতদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। আমাদের টিমের সবার অবদান রয়েছে। বয়সে অনেক ছোট ছিলাম, মাথাভর্তি প্লান ছিল অনেক, কিন্তু সব গুলো তো বাস্তবায়ন করতে পারিনাই। এখনো সেসব ছোট ছোট আইডিয়াগুলো নিয়ে ভাবি এবং এগুলো নিয়েই কাজ করতে চাই।" তবে এই পথটা এতটাও সহজ ছিলনা। তবুও সকল ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ছুটে চলেছেন নিজের স্বপ্নের পথে। শুধু স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেই নয়, শিক্ষার্থী হিসেবে সানজিদুল দেখিয়েছে তার মেধার প্রতিফলন। এইচএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি তে ৫৮ তম ব্যাচে এ প্রি-সী ক্যাডেট হিসেবে পড়াশোনা করছেন তিনি। তার এতদূরের জার্নি সম্পর্কে তিনি বলেন, "আমার ইচ্ছা ছিল ব্যতিক্রমী কিছু করার সেজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময়টাতে সংগঠন করেছি। সবাই অনেক বকাবকি করত, পড়াশোনা হবেনা, এগুলো করে লাভ নাই। আরো কত কি? কিন্তু কোনো কথা কানে নেইনি। যে যাই বলুক, থেমে থাকা যাবে না। ছোট বেলায় হোঁচট খেয়ে খেয়ে হাটতে শেখা হয়েছে। ঠিক একই রকম ভাবে জীবনে প্রতিটি ধাপে হোঁচট খেয়ে শিখতে হবে।"
অদম্য ইচ্ছা থাকলে সবকিছু না হলেও অনেক কিছু যে করা যায়, প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ রেখে চলেছেন সদ্য যৌবনে পা রাখা এই তরুণ সানজিদুল।