মোবাশ্বির হাসান শিপন: আমাদের বাতিঘর শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু মান্নান স্যার শতবর্ষী বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের(বর্তমান বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) সর্বকালের সেরা প্রধান শিক্ষক। ৯৫ বছর বয়স চলছে। নামাজ আর কোরআন তেলোওয়াতের মধ্যে দিন কাটছে তাঁর। জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে একখনও জামাতের সাথে নামাজ না পড়তে পারলে মন খারাপ হয়। কোন স্মীকৃতির পিছনে দৌঁড়াননি বরং স্মীকৃতি তাঁকে খুঁজে নিয়েছে। জেলা ছাড়িয়ে অসংখ্যবার যশোর বোর্ডের(তখন বরিশাল বোর্ড ছিলনা)সেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে জাতীয় পর্যয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হাত থেকে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে স্বর্ণপদক ও ১০ হাজার টাকার চেক গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর অসামান্য ভূমিকা। ১৯৭০ সালের বন্যার পর পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা ত্রাণ দেয়ার জন্য স্কুলে ক্যাম্প করে। ওই সময় সেনারা স্কুলের হাই-বেঞ্চ পুড়িয়ে রান্নার কাজ করে। স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেখে প্রতিবাদ করে। স্যারের কাছে পাকিস্তানী সেনারা ওই ছাত্রদের টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দিতে বলেন। স্যার অপারগতা প্রকাশ করলে সেনারা স্যারসহ ইংরেজী শিক্ষক প্রয়াত মোফাজ্জল হোসেন ও ছাত্রদের নামে থানায় মামলা দায়ের করেন। এরমধ্যে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধ। স্যার স্কুলের ছাত্রদেও মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উদ্ধুদ্ধ করেন। স্কুলের বোডিংয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সহযোগীতার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সবসময় কাছে পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে মুক্তিযদ্ধের সংগঠক সাবেক এমএলএ প্রয়াত রেজা-এ-করিম চুন্নু মিয়া,ভোলার মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার সদ্য প্রয়াত সিদ্দিকুর রহমানের জবানিতে ওই অবদানের কথা উঠে আসে। সিদ্দিকুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় মান্নান স্যারের নাম অর্ন্তভূক্ত করতে সম্মতির জন্য গেলে তিনি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি বলে ‘না’ বলে দেন।
মান্নান স্যার ১৯৫৪ সালে বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোদান করেন। দুই বছর পর ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৯৩ সালের জুন পর্যন্ত টানা ৩৭ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন। তাঁর সময়কালে আমার জানামতে উর্দূ স্যার(প্রয়াত মজিবুল হক স্যার)ব্যাতীত সব শিক্ষকই তার ছাত্র ছিলেন। আবার কেউ কেউ ছিলেন তাঁর ছাত্রেরও ছাত্র। স্যার যখন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়াতেন স্কুল বন্ধ কী খোলা বলা মুশকিল ছিল। মাঠ দূরে থাক স্কুলের বরান্দায়ও শুনশান নিরবতা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে। ব্যাখ্যাতীত বিনম্রতায় যে যার স্থানে। সিম্পল একটা শব্দ; কেউ কেউ বলে থাকেন। ভয়ে! স্যার কি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গালি-গালাজ করতেন? কিংবা শিক্ষার্থীদের মারতেন?পাঁচ বছরের শিক্ষা জীবন প্লাস আমার বাবা ঐ স্কুলের শিক্ষক থাকার কারণে আগে পরে মিলিয়ে একটু বেশীই দেখা হয়েছে স্যারকে।
শিক্ষকগণ সবাই তার ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও কাউকে তুই তোকারী করে সম্মোধন করতে কখনো দেখা যায়নি। এমনকি তুমি করেও বলতেন না। এমন শুনতাম মোফাজ্জল মিয়া, ইউসুফ মিয়া,মিছির মিয়া,শাহাজল মিয়া একটু শোনেন বা আসেন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম প্রথম স্যারেরা ঐ সম্বোধনে বিব্রত হতেন। স্যারদের ভাষায়, হেড স্যারকে যখন একা একা বলা হলো,স্যার আপনি আপনি করে ক্যামন যেন লাগে। স্যারের উত্তর,আমাকে চেয়ারের সম্মানতো দিতে হবে। আমি যদি তুই- তোকারী করি কিংবা এমন কিছু। শিক্ষার্থীরা ওটাই শিখবে। মানুষকে সম্মান দেয়া আর শিখবেনা। এ কথাগুলো আমার আমার বাবার কাছ থেকে শোনা।
স্যারকে বলা হয় ইংরেজীর ‘জাহাজ’। কিন্তু এমন কোন বিষয় নেই যাতে তাঁর পান্ডিত্য নেই। কী গণিত, কী বিজ্ঞান, কী ভূগোল সব তাঁর কাছে সহজ সমাধান। অনেক সময় দেখেছি অন্যান্য বিষয়ের স্যারগণও দ্বিধায় পড়লে স্যারের দাড়স্থ হতেন।
একটি মজার ঘটনা মনে পড়ছে। চার-সাড়ে চার ফুটের দেয়াল পত্রিকার জন্য আর্ট পেপার, রং পেন্সিল, কলম সহ যাবতীয় খরচের ভাউচার দিতে বললেন শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মান্নান স্যার। আমিসহ আমার সহ সম্পাদক বন্ধু আকবর সর্বসাক‚ল্যে বিরাশি টাকা খরচের ভাউচার দিলাম।
স্যার ভাউচারে চোখ বুলিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, তিন দিনে শেষ করতে পারবি। কাঁপুনি সহ বললাম জি স্যার। স্যার ভাউচারের কপিটা ছুড়ে দিয়ে বললেন,গাদা এটা ঠিক করে আন।
গর্দভ কন্ঠে বললাম, স্যার কি ভুল! আরে গাদা তিন দিন ধরে স্কুলে বসে কিছু না খেয়েই কাজ করবি,স্যারের জিজ্ঞাসা। শেষমেষ এক শত আট টাকার ভাউচার দিলেও স্যার বললেন, এত কমে হয়ে গেলে তো ভালোই!
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন সাইকেলে চড়ে মানিকার হাঁটের দিকে যাচ্ছি। সাইকেল চালাচ্ছে বন্ধু আকবর। পড়নে লুঙ্গি। হেলিপ্যাডের কাছে দূর থেকে দেখি রিক্স্রায় চড়ে স্যার বিপরীত দিকে আসছেন। আমি বললাম আকবর টাইগার আসছে! কই বলে আকবর সামনে তাঁকিয়েই ঝপাৎ করে নামতে গিয়ে সাইকেলে লুঙ্গি আটকিয়ে রাস্তায়। স্যার রিক্স্রা থামিয়ে নামলেন। আমাদেরতো মাথা আর উঁচু হয়না। স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, সম্মান দেখাতে গিয়ে হাড়গোর ভাঙ্গলে কে দিত! ‘আমাকে দেখলে আর এভাবে নামাবি না।’
১৭ এপ্রিল, ২০২৩ সোমবার। মডেল মসজিদ আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে স্যার এসেছিলেন। এক জনমে স্কুলের কাছে যেমন নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন; তেমনি তাঁর আরেক সত্ত¡া ছিল সাবেক হাইস্কুল মসজিদ বা মারকাজ মসজিদ বা ঈদগাহ মসজিদ। অন্যান্য দিনের চেয়ে তাঁর সরব উপস্থিতি ছাড়িয়ে যেত বৃহস্পতিবারের ‘জোড়’ আর শবগুজারির দিন। মসজিদ ভর্তি মুসুল্লি। স্যার বয়ান করছেন। পিনপতন নিস্তব্দতায় মুসুল্লিরা শুনছেন। আবার কখনো অন্য কেউ বয়ান করছেন। সকালে মুসুল্লিদের জমাতবদ্ধ করে পাঠিয়ে দিতেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ' প্রকৃত অর্থে শিক্ষক বলতে যা বোঝায় এ মানুষটি তা-ই। ব্যক্তি পরিচয় ছাঁপিয়ে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। কিন্তু কখনও তাঁর ভিতর এ অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়নি। স্যার অবসরে গেছেন ৩০ বছর। যদি ভয়ের বিষয় হয় তাহলে স্যার এখনো রিক্সা চড়ে পাশ গেলে অথবা পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটায় কে! সবই শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসার অদ্ভুত রসায়ন। এটাকে ভাষা দিয়ে বর্ননা করা খুব কঠিন। কিন্তু এর অস্তিত্ব আকাশ ছাড়িয়ে।