অনলাইন সংস্করণ | ভোলা, শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪ | ১৫ই চৈত্র ১৪৩০


জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে ভোলাসহ উপকূলের জেলেদের জীবন


এ আর সোহেব চৌধুরী

প্রকাশিত: ৪ঠা অক্টোবর ২০২০ রাত ১০:১৮

remove_red_eye

৫২০




এআর সোহেব চৌধুরী, চরফ্যাশন থেকে :  জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে জেলেদের জীবন। ধারাবাহিক নদী ও সমুদ্রে জীবিকা নির্বাহের পট পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে। এমনটাই দাবি করছেন চরাঞ্চলের জেলেরা। বন্যা ও ঝর জলচ্ছাস এবং টর্নেডোর তান্ডব,জোয়ারের গতির তীব্রতা,নদী ভাঙ্গনসহ নদী সমুদ্রে মাছ উৎপাদন কমে যাওয়ায় জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে একমাত্র পেশা জেলে জীবন থেকে সরে যাচ্ছেন অনেক জেলে। বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন এসব জেলেরা। উপজেলার নদী ও সমুদ্র মোহনায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেরা জানান,নদী প্রকৃতির জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে পরিবেশের সাথে মানুষের অযাচিত আচরণের কারণে। যার জন্য বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে তারা তাদের পরিবার নিয়ে প্রতিনিয়ত জীবনের ধারাবাহিকতা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন।

ভাঙ্গণ কবলীত নদী উপকূলে বসবাসরত জেলেদের প্রতিবছরে একাধিকবার বসতবাড়ি নিয়ে অন্যত্র বসতী স্থাপন করতে হয়, সেই সাথে জেলে শিশুরাও স্বপ্ন ভাঙ্গা শৈশব নিয়েই ব্যথাতুর স্মৃতি বয়ে বেড়ায় সাড়া জীবনভর। কখনো মসজিদ কিংবা মন্দির,কখনো স্কুল বা মাদ্রাসা আবার কখনোও বা খেলার মাঠ বাজার অথবা ঘাট চলে যাচ্ছে নদী গর্ভে। উপকূলের জনজীবনটাই যেন দুঃস্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত কোনো এক সভ্যতায়। এমনটাই বলছেন ধারাবাহিক জীবনে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতায় মাইগ্রেশনের শিকার জেলেরা।

চরফ্যাশনের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের ভোলা জেলা সহকারি পরিচালক রাশিদা বেগম জানান, কার্বনের উষ্ণতায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলে নদী ও সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে। ফলে নানান দুর্যোগে বন্যা,খড়া,ঝর জলচ্ছাস ও টর্নেডো এবং লবনাক্ততা বাড়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শিকার হতে হচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। আসলামপুরের প্রবীন জেলে সাজাহান ফরাজি বলেন, নদীকে মানুষ তার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ব্যবহার করছে। ইঞ্জিনচালিত বোট বা নৌকা ট্রলারের প্রতিযোগীতার কারণে এবং কলকারখানার রাসায়নিক বর্জে নদী দুষিত হয়ে যাওয়ায় এবং প্রয়োজনের তুলনায় মাছ বেশি শিকার ও মাছের প্রজনন কমার জন্য নদী আজ মাছ নেই। ফলে নদী হাড়িয়েছে তার জীববৈচিত্র।


ঢালচর ইউনিয়নের জেলে আবদুর রহিম(৫২) নাসির(৭২)বেলাল(৩৪)ফারুক(৩৫)আবদুস সালাম (৫২)  বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সাগর উপকূলে বসবাস করা সত্বেও সাগরে গিয়ে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছেনা। এছাড়াও বন্যা,তুফানের মধ্যে মাছ শিকার করা সম্ভব হচ্ছেনা। ২যুগ আগেও নদী সাগরে মাছ শিকার করে অনেক জেলেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে রাতারাতি জীবন বদলে ফেলতেন। বর্তমানে নদী ভাঙ্গনের ফলে এবং বন্যা তুফানে আমাদের জন জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় জেলে মৃত রহিমের স্ত্রী রোশনা বিবি(৬০) বজলুর রহমানের স্ত্রী ছকিনা বেগম জানান, ২০বছরে নদী ভাঙ্গনে ১২বার ভাঙ্গণের শিকার হয়ে বসত বাড়ি হাড়িয়ে এখন নিঃস্ব অবস্থায় জীবন যাপন করছি। ইয়ানুর বেগম (৬০) জানান,আমাদের ঢালচরে প্রায় এক একর জমি ছিলো কিন্তু নদী ভাঙ্গনে সব হাড়িয়ে এখন জীবিকা সংকটে আছি। একই এলাকার জেলে দুলাল ও সফিক, বলেন,সাগরে ঝরের কবলে পড়ে ট্রলার ও জাল হাড়িয়ে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি এছাড়াও নদী সাগরে মাছের সংকট দেখা দেয়ায় জেলে পেশা বন্ধ করে বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজছি। চরফ্যাশনের মুজিব নগর ইউনিয়নের জেলে সালাহ উদ্দিন মাঝি বলেন, চলতি বছরে সাগরের গভীরে মাছ শিকার করতে গিয়ে হটাৎ টর্নেডোর আঘাতে ১৬জন জেলেসহ ট্রলার ও জাল হাড়িয়েছি ১০ জেলে উদ্ধার হলেও ৬ জেলে নিখোঁজ হয়ে যায়।

চর কুকরি-মুকরি,মাদ্রাজ,হাজারিগঞ্জসহ বিভিন্ন চারাঞ্চলে ঝর-তুফান নদী ভাঙ্গনে সংগ্রাম করে হাজার হাজার জেলের বসবাস করছে। এসব জেলেরা নদী ও সমুদ্রে মাছ শিকার করে ধারাবাহিকভাবে হাটবাজারে এসব মাছ বিক্রি করে যুগবন্ধী হলেও জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে মাছ সংকট সৃষ্টি হয়েছে ভোলার উপকূলে। জেলেদের জালে মাছ শূন্যে জীবিকা নির্বাহে সংকট দেখা দেয়ায় মেঘনার উপকূল ঘেঁষা খালে ও চর চরাঞ্চলে শত,শত ট্রলার এখন অলস পড়ে থাকে। সকাল দুপুর ও পড়ন্ত বিকেল গড়িয়ে গেলেও ডিঙ্গি বা ট্রলারের রঙ্গিণ পতাকাগুলো বাতাসে উড়তে দেখা গেলেও র্দীঘ দিন ধরে নদীতে যাচ্ছেনা এসব ট্রলার।
উপজেলা জলবায়ু ফোরামের সভাপতি এম আবু সিদ্দিক বলেন, জলবায়ুর চিত্রপট পাল্টে যাওয়ায় ঋতু চক্রের ধারাবাহিকতা পরিবর্তন হয়ে গেছে। যার জন্য নদী ও সাগরে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র পরিবর্তন হয়েছে। ফলে অনভিজ্ঞ জেলেরা ঘুরে ফিরে একই এলাকায় মৎস্য শিকারে যাওয়ায় মাছ কম পাচ্ছে তারা। এছাড়াও বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পানির উচ্চতা ও জোয়ারের গতি প্রকৃতি এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। যার জন্য প্রতিযোগী জেলেদের জীবিকা নির্বাহে নদী সমুদ্রের ধারাবাহিকতাও ধিরে,ধিরে কমছে। বৈশ্বিকভাবে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব না কমাতে পাড়লে পুরো মানব জাতিই এক চেলেঞ্জিং সংকটে পড়বে বলে মনে করি।
 উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হেসেন মিনারের সাথে কথা বললে তিনি জানান, সম্প্রতি অতি বৃষ্টির রেকর্ড বিগত ১০ বছরের বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি হওয়ায় এবং বিগত বছরের তুলনায় ঝড়ঞ্জা বেড়ে যাওয়ায় নদী ও সমুদ্রে জীবিকা নির্বাহে জেলে পেশা কমছে। এছাড়াও নদী ও সাগরে মাছের সংখ্যা কমলেও বড় মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অঞ্চলের জেলেরা মূলত দিন এনে দিন খাওয়ার ফলে মাছের অভয়ারণ্য গভীর সমুদ্রে তারা কম যাচ্ছে। এবং স্থানীয় নদী উপকূলে মাছের বিচরণ ক্ষেত্র পাল্টে যাওয়ায় উপকূলীয় নদীতে মাছের সংখ্যা কমেছে কিন্তু জেলেরা এসব অঞ্চলে মৎস্য শিকারে যাওয়ার ফলে সম্প্রতি বছর মাছের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে জেলেরা যদি সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ি মাছের অভয়ারণ্য গভীর সমুদ্র ও নদীতে মাছের বিচরণ এলাকায় যায় তাহলে তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। পাশাপাশি তারা সঠিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরী করতে পাড়ে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলা-২ এর উপ বিভাগীয় প্রকৌশলি মিজানুর রহমান বলেন, চরফ্যাশন উপজেলার নদীভাঙ্গণ কবলীত এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মান করা হচ্ছে। এছাড়াও কার্বন নিঃস্বরনে বেড়িবাঁধের ঢালে বৃক্ষ রোপন করাও হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভোলা জেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ পরবর্তী মেঘনা নদীর পানি সমতল বিপদ সিমার ১১৫ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে যা স্মরণকালের সর্বচ্চ রেকর্ড। এবং এর ফলে বেড়ি বাধের বাহিরে নি¤œাঞ্চল তলিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার সাথে সাথে বেড়ি বাধের উচ্ছতাও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ভোলা জেলার বেড়িবাধের উচ্চতা বৃদ্ধিতে পর্যায়ক্রমে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।